মুহাম্মদ সিরাজুল হক: মুমিন বান্দা হিসেবে আল্লাহপাকের মহব্বত লাভ করা জীবনের চূড়ান্ত আশা ও উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। আল্লাহতায়ালার প্রেম-ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে তাঁর নৈকট্য লাভ করা মানব জীবনের চরম ও পরম উদ্দেশ্য হওয়াই বাঞ্ছনীয়।
সুতরাং আল্লাহপাকের মহব্বত লাভের উপায় কী হবে? এ প্রসঙ্গে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ঘোষণা করেন- (হে নবী) আপনি বলে দিন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসতে চাও তাহলে আমার অনুসরণ কর। আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন। আর তোমাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করবেন এবং আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম করুণাময় (সূরা আলে ইমরান : আয়াত ৩১)।
এ আয়াতে আল্লাহতায়ালা সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের মহব্বতের দাবিদার হবে তাকে তার কথায় ও কাজে চিন্তা-চেতনায় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিটি স্তরে প্রিয়নবী (সা.)-এর আদর্শের অনুসারী হতে হবে। কেননা আল্লাহতয়ালা বলেছেন, ‘রাসূল তোমাদেরকে যা দান করেন বা নির্দেশ দেন তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা থেকে তোমাদেরকে নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক।’ (সূরা হাশর : আয়াত ৭)।
একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি লাভ করার ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মহব্বতকে আল্লাহপাক প্রাধান্য দিয়েছেন। কারণ আল্লাহপাক রাসূলুল্লাহকে বেশি ভালোবাসতেন। এর একটি প্রমাণ হল কিবলা পরিবর্তনের ঘটনায়। হিজরতের পর ষোলো-সতেরো মাস আল্লাহতায়ালার নির্দেশক্রমে নবী করিম (সা.) বায়ুতুল মোকাদ্দাসের দিকে ফিরে নামাজ আদায় করেন।
কিন্তু তার আন্তরিক ইচ্ছা ছিল যেন কা’বা ঘরকে কিবলা নির্ধারণ করা হয়। আল্লাহপাক তাঁর সেই ইচ্ছা পূরণ করেছেন। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন- ‘আকাশের দিকে আপনার বারবার তাকানো আমি অবশ্য লক্ষ্য করেছি। সুতরাং আপনাকে অবশ্যই এমন কিবলার দিকে ফিরিয়ে দিচ্ছি যা আপনি পছন্দ করেন।
অতএব, আপনি মসজিদুল হারামের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিন।’ (সূরা বাকারা : আয়াত ১৪৪)। প্রিয়নবী (সা.) যা চেয়েছেন আল্লাহতায়ালা তা পূরণ করেছেন। তিনি যে আল্লাহপাকের সর্বাধিক নৈকট্যের অধিকারী এ আয়াতে তা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
বস্তুত আল্লাহতায়ালার মহব্বত লাভের জন্য আল্লাহর প্রিয় হাবিব হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মহব্বতকে শর্ত হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সুতরাং মহানবী (সা.)-এর মহব্বত কীভাবে লাভ করা যাবে এ প্রসঙ্গে নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন- যে পর্যন্ত আমি তোমাদের পিতা-মাতা, সন্তানসন্ততি এবং সমগ্র মানুষের চেয়ে অধিকতর প্রিয় না হই ততক্ষণ পর্যন্ত তোমরা পূর্ণাঙ্গ মুমিন হতে পারবে না। (বুখারি ও মুসলিম)।
এ হাদিস শ্রবণের পর হজরত উমর (রা.) আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.) আমার সন্তানসন্ততি তথা সব আপনজন থেকে আপনি আমার থেকে অধিক প্রিয় কিন্তু আমার মনে হয়, আমার প্রাণ আমার কাছে আপনার চেয়ে অধিক প্রিয়। তখন নবী করিম (সা.) তার হস্ত মোবারাক হজরত উমর (রা.)-এর বক্ষে স্থাপন করেন।
একটু পর হজরত উমর (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! এখন আপনি আমার প্রাণের চেয়েও বেশি প্রিয়। মূলত প্রিয়নবী (সা.)-এর প্রতি সাহাবায়ে কেরাম (রা.) মহব্বতের যে প্রমাণ পেশ করেছেন তা বর্ণনাতীত।
একবার মক্কা মোয়াজ্জমায় এ গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ল যে, কাফেররা নবী করিম (সা.) কে বন্দি করেছে অথবা শহীদ করেছে। এ কথা শ্রবণ করা মাত্র হজরত জোবায়ের ইবনুল আওয়াম (রা.) তরবারি হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন এবং নবী করিম (সা.) গৃহে উপস্থিত হলেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) কে নিরাপদ অবস্থায় দেখে তিনি শান্ত হলেন।
নবী করিম (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার, তুমি তরবারি হাতে নিয়ে কেন এসেছ? তিনি বললেন, আমার পিতা-মাতা আপনার ওপর কোরবান হোক। আমি শুনেছি, কাফেররা আপনাকে বন্দি অথবা শহীদ করেছে। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ঘটনা যদি তাই হতো তবে তুমি কী করতে? হজরত জোবায়ের (রা.) আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.) এ অবস্থায় আমি কাফেরদের সঙ্গে যুদ্ধ করে প্রাণ দিতাম। এতে নবী করিম (সা.) অত্যন্ত আনন্দিত হলেন।
হজরত যায়দ ইবন হারিসা (রা.) ছিলেন দশ-এগারো বছর বয়সের একজন কিশোর। সম্ভ্রান্ত ঘরের এ কিশোরকে দুষ্কৃতকারীরা অপহরণ করে এনে মক্কার বাজারে বিক্রি করে। হজরত খাদিজাতুল কুবরা (রা.)-এর এক আত্মীয় তাকে ক্রয় করে আনে। উম্মুল মুমেনিন তাকে প্রিয়নবী (সা.)-এর খেদমতে নিয়োজিত করেন।
কিছুদিন পর খোঁজ পেয়ে তার পিতা-পিতামহ তাকে নেয়ার জন্য আগমন করে। কিন্তু এরই মধ্যে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মহব্বত তার অন্তরে স্থান করে নিয়েছে। তাই তিনি পিতা ও পিতামহের সঙ্গে যেতে রাজি হলেন না বরং নবী করিম (সা.)-এর পদতলে লুটিয়ে ক্রন্দন করতে লাগলেন। প্রিয় নবী (সা.) তাকে বুকে টেনে নিলেন এবং ঘোষণা করলেন, আজ থেকে তুমি আমার পুত্র।
বস্তুত মহানবী (সা.)-এর প্রতি সাহাবায়ে কেরামের ভালোবাসা ও মহব্বতের কথা বলে শেষ করা যাবে না। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের করুণা ও ভালোবাসা লাভ করতে হলে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি সর্বাধিক ভালোবাসা রাখতে হবে এবং সর্বক্ষেত্রে তার পরিপূর্ণ অনুসরণ করতে হবে। তিনি যে আদর্শ রেখে গেছেন তার দু-একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করা হল।
(ক) ঈদের দিন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে একটি শিশু কাঁদছে। রাসূলে পাক (সা.) সে পথে যাওয়ার সময় শিশুটিকে এ অবস্থায় দেখে øেহমাখা সুরে জিজ্ঞেস করলেন, বাবা তোমার কী হয়েছে? শিশুটি কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমার বাবা নেই। ঈদের দিনে নতুন কাপড় আমার নেই। আমার সাথীরা নতুন কাপড় পরে খেলাধুলা করছে। দয়ার নবী শিশুটিকে নতুন কাপড় কিনে দিয়ে নিজের বাড়িতে নিয়ে এলেন। কন্যা হজরত ফাতেমা (রা.) কে বললেন, তোমার একটি ভাই নিয়ে এসেছি। তাকে গোসল দিয়ে নতুন কাপড় পরিয়ে দাও। কিছু মিষ্টান্ন খাইয়ে দিয়ে শিশুদের সঙ্গে খেলতে পাঠিয়ে দাও। হজরত ফাতেমা (রা.) শিশুটিকে নতুন কপড় পরালেন। শিশুটি মনের আনন্দে অন্য শিশুদের সঙ্গে খেলায় মেতে উঠল।
(খ) মক্কা বিজয়ের কয়েকদিন পর এক বৃদ্ধা তার সামান্য মালামাল পুঁটলি বেঁধে মক্কা ছেড়ে চলে যাচ্ছে। কিন্তু বয়সের কারণে পুঁটলি বহন করা তার পক্ষে কষ্ট হচ্ছিল। নবী করিম (সা.) এসে তাকে দেখে জিজ্ঞেস করেন, মা তুমি কোথায় যাচ্ছ? বৃদ্ধা বলল, অমুক যায়গায় আমার আত্মীয়ের বাড়িতে যাচ্ছি। কেন যাচ্ছ এ প্রশ্নের জবাবে বৃদ্ধা বলল, শুনেছি মুহাম্মদ নামে এক ব্যক্তি আমাদের বাপ-দাদার ধর্মের বিরুদ্ধে এক নতুন ধর্ম প্রচার করছে। তাই জীবন রক্ষার জন্য মক্কা ছেড়ে চলে যাচ্ছি। রাসূলুল্লাহ (সা.) এবার বৃদ্ধার বোঝাটি নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে বললেন, মা তুমি আমার সঙ্গে চল তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেব। বৃদ্ধাকে তার আত্মীয়ের বাড়ি দিয়ে নবী করিম (সা.) বললেন, তুমি এখানে থাক আমি যাচ্ছি। বৃদ্ধা বলল, বাবা তুমি কে? আমার জন্য এত কষ্ট করেছ? দ্বীনের নবী বললেন, আমার নাম মুহাম্মদ। আপনি যার কথা শুনেছেন আমিই সেই মুহাম্মদ। আমিই ইসলামের কথা বলে থাকি এবং এক আল্লাহর ইবাদতের কথা প্রচার করে থাকি। বৃদ্ধা বলল, যদি এটাই হয় ইসলাম তা হলে আমি গ্রহণ করতে রাজি। এ বলে তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে কালেমা পাঠ করে ইসলাম গ্রহণ করে ইসলামের ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেন।
(গ) এক বুড়ি না বুঝেই ইসলামের বিরোধিতা করত এবং নবী করিম (সা.) কে কষ্ট দেয়ার জন্য মসজিদে যাতায়াতের পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখত। একদিন পথে কাঁটা না দেখে তার কোনো অসুখ হল কিনা এই ভেবে দয়ার নবী বুড়ির খোঁজে তার বাড়ি গিয়ে পৌঁছেন। গিয়ে দেখেন বুড়ি অসুস্থতার কারণে বিছানায় শুয়ে ছটফট করছে। তিনি তখন ওষুধের ব্যবস্থা করে দিয়ে তার সেবা করতে লাগলেন। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পরিচয় পেয়ে বুড়ি হতবাক হলে গেল। তার অমায়িক ব্যবহার দেখে বুড়ি ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হয়ে গেল।
(ঘ) ওহুদ যুদ্ধের পরের বছর কুরাইশরা আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে দশ হাজার সৈন্যসহ মদিনা আক্রমণের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। মহানবী (সা.) এ সংবাদ পেয়ে সাহাবায়ে কেরামদের সঙ্গে মরামর্শ করলেন। হজরত সালমান ফারসি (রা.)-এর পূর্ব অভিজ্ঞতা অনুযায়ী মদিনার চুতুর্দিকে পরিখা খননের পরামর্শ দেন। যাতে আবু সুফিয়ানের বাহিনী পরিখা অতিক্রম করে মদিনা আক্রমণ করতে না পারে। বিশ্ববাসী (সা.) মুসলিম বাহিনীর প্রধান ছিলেন। কিন্তু বসে না থেকে সাহাবায়ে কিরামের সঙ্গে পরিখা খননের কাজ করেন। প্রথমে তিনিই নিজ হাতে জমিতে কোদাল চালিয়ে খনন কাজ শুরু করেন। আর তখন তার মুখে ছিল ‘প্রথমেই আল্লাহর নামে শুরু করছি, আর আমরা যদি অন্য কারও ইবাদত করি তবে আমরা বড়ই দুর্ভাগা হয়ে যাব। তিনি কতই না উত্তম প্রভু, আর তার দ্বীন কতই না উত্তম দ্বীন।’ (ফাতহুল বারী, ৭ম খ. পৃ.৩০৪)।
সুতরাং আল্লাহতায়ালার মহব্বত লাভেল জন্য সাহাবায়ে কেরামদের মতো নবী করিম (সা.)-এর প্রতি আন্তরিক মহব্বত রাখতে হবে। এটা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বাস্তব জীবনে আমলের মাধ্যমে বিশ্বনবী (সা.) যে আদর্শ রেখে গিয়েছেন তা যথাযথভাবে অনুসরণ করা হলে ইহকাল ও পরকালের কল্যাণ লাভ করা সহজ হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক